সুস্থ থাকতে জানতে হবে আমাদের দেহের সিমপ্যাথেটিক ও প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম

সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (Sympathetic Nervous System)

সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম হলো আমাদের শরীরের একটি অংশ, যা মূলত বিপদের সময় বা উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় শরীরকে দ্রুত সাড়া দিতে সাহায্য করে। একে সহজভাবে বলা হয় “ফাইট অর ফ্লাইট” প্রতিক্রিয়া, অর্থাৎ যখন শরীরকে কোনো সংকটময় বা বিপদজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়, তখন এটি সক্রিয় হয়। অর্থাৎ সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম কাজ করে যখন আপনি বিপদে পড়েন, দৌড়ান, বা কোনো চাপে থাকেন। এটি আপনাকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

হৃদস্পন্দন বাড়ানো: বিপদে পড়লে বা দৌড়ানোর সময় শরীরকে বেশি শক্তি দরকার হয়, তাই সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম হৃদপিণ্ডকে দ্রুত স্পন্দন করতে বলে, যেন রক্ত দ্রুত চলাচল করে।

রক্তচাপ বাড়ানো: বেশি রক্ত চলাচলের জন্য রক্তচাপ বাড়ে, যেন শরীরের পেশীগুলো বেশি অক্সিজেন পায়।

শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত করা: ফুসফুসের ব্রংকিয়াল টিউবগুলো প্রসারিত হয়, যাতে বেশি অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

পিউপিল প্রসারণ: চোখের মণি বড় হয়ে যায়, যাতে বেশি আলো ঢোকে এবং পরিস্থিতি ভালোভাবে দেখা যায়।

হজম বন্ধ রাখা: বিপদে পড়লে বা উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে শরীর হজম বন্ধ করে, কারণ তখন শক্তির দরকার বেশি, যা শরীর অন্য কাজে লাগাতে চায়।

সহজে মনে রাখুন, আপনি যখন হঠাৎ কোনো কুকুরের সামনে পড়ে দৌড়াতে শুরু করেন, তখন সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম আপনার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে, শ্বাস দ্রুত করে, এবং শক্তি সরবরাহ করে আপনাকে দ্রুত পালাতে সাহায্য করবে।

প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (Parasympathetic Nervous System)

প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম হলো শরীরের এমন একটি অংশ, যা শরীরকে বিশ্রাম এবং পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। এটি সাধারণত “রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট” অর্থাৎ “বিশ্রাম এবং হজম” প্রতিক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। যখন শরীর শিথিল অবস্থায় থাকে, তখন এই সিস্টেম কাজ করে। মানে হলো প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম কাজ করে যখন আপনি শিথিল থাকেন, খাচ্ছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন। এটি শরীরকে শিথিল করে, শক্তি সঞ্চয় করে, এবং হজম প্রক্রিয়া চালায়।

হৃদস্পন্দন ধীর করা: শরীর যখন বিশ্রামে থাকে, তখন হৃদপিণ্ডকে ধীরে কাজ করতে বলা হয়, যেন শরীরের শক্তি সঞ্চয় হয়।

হজম প্রক্রিয়া চালানো: প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম হজমতন্ত্রকে সক্রিয় করে, যেন শরীর ঠিকমতো খাবার হজম করতে পারে এবং পুষ্টি শোষণ করতে পারে।

শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর করা: শরীর যখন বিশ্রামে থাকে, তখন শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে যায়।

রক্তচাপ কমানো: যখন শরীর বিশ্রামে থাকে, রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে এবং শরীরের শক্তি বাঁচানো হয়।

পিউপিল সংকুচিত করা: বিশ্রামের সময় চোখের মণি ছোট হয়ে যায়, কারণ তখন বেশি আলো দরকার হয় না।

সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম, প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়?

সিমপ্যাথেটিক (Sympathetic) এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক (Parasympathetic) নার্ভাস সিস্টেম শরীরের স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্রের (Autonomic Nervous System – ANS) অংশ এবং এই সিস্টেমগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে, অর্থাৎ আমাদের সচেতন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। তবে এই সিস্টেমগুলো মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বিভিন্ন রাসায়নিক ও হরমোনের মাধ্যমে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়। নিচে সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়

উদ্ভব এবং কার্যক্রম- সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus) এবং মস্তিষ্কের স্টেম (Brainstem) এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।

সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম মূলত থোরাকো-লাম্বার আউটফ্লো (Thoracolumbar Outflow) থেকে উদ্ভূত হয়, অর্থাৎ মেরুদণ্ডের থোরাসিক এবং লাম্বার অংশ (T1 থেকে L2 পর্যন্ত) থেকে নার্ভ বের হয়।

প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র- হাইপোথ্যালামাস: এটি অটোনোমিক সিস্টেমের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। যখন কোনো বিপদ বা উত্তেজনা দেখা দেয়, তখন হাইপোথ্যালামাস সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করার সংকেত পাঠায়।

সক্রিয়করণের প্রক্রিয়া- সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হলে অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড থেকে অ্যাড্রেনালিন (এপিনেফ্রিন) এবং নোরএপিনেফ্রিন নিঃসরণ হয়। এই রাসায়নিকগুলো আমাদের শরীরকে “ফাইট-অর-ফ্লাইট” প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত করে। এর ফলে: হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস বৃদ্ধি পায়, রক্তচাপ বাড়ে, পেশীতে রক্তপ্রবাহ বাড়ে এবং শরীর শক্তিশালী ও সক্রিয় হয়।

প্রতিক্রিয়া:  যখন মস্তিষ্ক থেকে সংকেত আসে (যেমন বিপদের অনুভূতি, স্ট্রেস, বা কোনো শারীরিক সংকেত), তখন সিমপ্যাথেটিক নার্ভগুলো সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সংকেত পাঠায়। মস্তিষ্কে চোখের মণি বড় করা, হজম প্রক্রিয়া ধীর করা, এবং শক্তির সঞ্চালন ত্বরান্বিত করা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে।

প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়

উদ্ভব এবং কার্যক্রম- প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম মূলত ক্রেনিওস্যাক্রাল আউটফ্লো (Craniosacral Outflow) থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি মস্তিষ্কের কিছু ক্রেনিয়াল নার্ভ (Cranial Nerves) এবং স্যাক্রাল S2-S4 নার্ভ থেকে উদ্ভূত হয়।

প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রহাইপোথ্যালামাস: এটি প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকেও নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বিশ্রাম এবং শিথিল অবস্থায় কার্যকর করার জন্য নির্দেশ দেয়। হাইপোথ্যালামাস যখন সংকেত পায় যে শরীরকে শিথিল করতে হবে বা শক্তি সঞ্চয় করতে হবে, তখন এটি প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করে।

সক্রিয়করণের প্রক্রিয়াভেগাস নার্ভ (Cranial Nerve X) প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের প্রধান নার্ভ হিসেবে কাজ করে। এটি হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, এবং হজমতন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে।

    যখন প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হয়:

        হৃদস্পন্দন ধীর হয়।

        শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়।

        হজম প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়।

        মূত্রথলি সংকোচন হয় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শিথিলতা আসে।

রাসায়নিক প্রভাব: প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের সংকেতগুলি অ্যাসিটাইলকোলিন (Acetylcholine) নামক রাসায়নিকের মাধ্যমে কাজ করে, যা হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, এবং হজমতন্ত্রের কার্যকলাপ ধীর করে এবং শিথিলতা প্রদান করে।

নিয়ন্ত্রণের সামঞ্জস্যতা

  • সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম পরস্পরের বিপরীতভাবে কাজ করে।
  • যখন সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হয়, শরীর শক্তি ব্যয় করে এবং বিপদ থেকে রক্ষা পায়।
  • প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সেই বিপদের পর শরীরকে পুনরায় শিথিল করে এবং শক্তি সংরক্ষণ করে।
  • হাইপোথ্যালামাস এই দুটি সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী একটিকে সক্রিয় ও অন্যটিকে নিষ্ক্রিয় করে। এটি শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও ভারসাম্য বজায় রাখে।

আমাদের নাগরিক জীবনের অনিদ্রা, বদ হজম, কোষ্ঠ কাঠিন্য ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম, প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কিভাবে জড়িতে? আমাদের পারসোনালিটিটি টাইপের সাথে এর সম্পর্ক কেমন?

সিমপ্যাথেটিক (Sympathetic) এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক (Parasympathetic) নার্ভাস সিস্টেম আমাদের শরীরের স্বায়ত্তশাসিত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদের নাগরিক জীবনের অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন অনিদ্রা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ইত্যাদির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এসব সমস্যার পেছনে মানসিক চাপ, জীবনযাত্রার ধরণ, এবং ব্যক্তিত্বের ধরন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১. সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম এবং নাগরিক জীবনের স্বাস্থ্য সমস্যা

সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম আমাদের শরীরের “ফাইট-অর-ফ্লাইট” প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, যা সাধারণত চাপ, উত্তেজনা বা বিপদের সময় সক্রিয় হয়। কিন্তু আধুনিক নাগরিক জীবনে ক্রমাগত মানসিক চাপ, কাজের চাপে পড়া, এবং সামাজিক প্রতিযোগিতা প্রায়ই সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে অতিরিক্ত সক্রিয় করে তোলে। এর ফলে বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।

সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত সক্রিয়তা এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অপর্যাপ্ত সক্রিয়তা ও স্বাস্থ্য সমস্যার সম্পর্ক:

    অনিদ্রা (Insomnia):

        যখন সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে, তখন শরীর শিথিল হতে পারে না। হৃদস্পন্দন বাড়া, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, এবং মানসিক চাপ থাকার কারণে রাতে ঘুম আসতে সমস্যা হয়।

        দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ এবং সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত উত্তেজনা অনিদ্রা তৈরি করে।

    বদহজম (Indigestion):

        সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম যখন সক্রিয় হয়, তখন হজম প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়, কারণ তখন শরীর বেশি শক্তি হজমে ব্যয় করতে চায় না।

        বদহজম, পেট ব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত সক্রিয়তার একটি সাধারণ ফল।

    কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation):

        সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম হজমতন্ত্রের কাজ ধীর করে দেয়, বিশেষ করে অন্ত্রের চলাচল কমিয়ে দেয়, যার ফলে মলত্যাগ করতে সমস্যা হয়।

        দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ এবং সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত সক্রিয়তা কোষ্ঠকাঠিন্য তৈরি করতে পারে।

    হৃদস্পন্দন ও উচ্চ রক্তচাপ (Increased Heart Rate and Hypertension):

        চাপের কারণে সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বাড়ায়, যা দীর্ঘমেয়াদে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে।

ব্যক্তিত্বের ধরণ (Personality Type) এবং অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেমের সম্পর্ক

ব্যক্তিত্বের ধরণ আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের প্রতিক্রিয়ার ধরনকেও প্রভাবিত করে। কিছু মানুষ বেশি চাপগ্রস্ত হয়, আবার কিছু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই শিথিল থাকে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের কার্যকারিতা প্রভাবিত করে।

টাইপ A এবং টাইপ B ব্যক্তিত্বের প্রভাব:

টাইপ A ব্যক্তিত্ব: টাইপ A ব্যক্তিত্বের লোকেরা সাধারণত উচ্চাভিলাষী, প্রতিযোগিতাপূর্ণ, এবং দ্রুত উত্তেজিত হয়। এরা প্রায়ই স্ট্রেস বা মানসিক চাপ অনুভব করে। এই ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম বেশি সক্রিয় থাকে, যা তাদের হৃদস্পন্দন বাড়ায়, হজমে সমস্যা তৈরি করে এবং ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।

টাইপ B ব্যক্তিত্ব: টাইপ B ব্যক্তিত্বের লোকেরা সাধারণত বেশি শান্ত এবং ধীরস্থির হয়। এদের মধ্যে প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম বেশি সক্রিয় থাকে, ফলে এরা বেশি শিথিল থাকে এবং তাদের মধ্যে অনিদ্রা, বদহজম বা কোষ্ঠকাঠিন্য কম দেখা যায়।

স্ট্রেস ব্যবস্থাপনার দক্ষতা এবং স্নায়ুতন্ত্রের প্রভাব: যারা মানসিক চাপকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাদের মধ্যে প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় থাকে, এবং এরা সাধারণত বেশি স্বাস্থ্যবান থাকে। যারা সহজেই উত্তেজিত বা চাপগ্রস্ত হয়, তাদের মধ্যে সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম বেশি সক্রিয় থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে।

স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো এড়াতে কিছু কার্যকরী সমাধান হতে পারে:

ইবাদাত বা প্রার্থণায় নিয়মিত হওয়াঃ নিয়মিত ধীরস্থির ভাবে সালাত আদায় করা। জিকর বা অন্যান্য ইবাদাত এ গভীরভাবে মনোনিবেশ করা এতে স্ট্রেস কমে ও প্যারাসিম্প্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হয়।

 মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম: এগুলো প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে এবং শরীরকে শিথিল করতে সহায়ক হয়।

শারীরিক ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

মানসিক চাপ কমানো: স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশল যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়মিত অনুশীলন, প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করতে সহায়ক হতে পারে।

সুস্থ জীবনযাপন: সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম ব্যালান্স করার জন্য উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস

১. হোল গ্রেইন বা সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার (Whole Grains):

কেন উপকারী: সম্পূর্ণ শস্য যেমন ব্রাউন রাইস, ওটস, এবং বার্লি ধীরে হজম হয় এবং শরীরে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ ছেড়ে দেয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখে।

কিভাবে সহায়ক: হোল গ্রেইন প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় রাখতে সহায়ক, কারণ এটি হজমের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং শক্তি সরবরাহ করে শরীরকে শিথিল রাখে।

২. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার: মাছ (যেমন সালমন, ম্যাকারেল), চিয়া সিড, আখরোট, ফ্ল্যাক্স সিড।

কেন উপকারী: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। এটি মস্তিষ্কের জন্য স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা উন্নত করে।

কিভাবে সহায়ক: ওমেগা-৩ স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করতে সহায়ক।

৩. প্রবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক খাবার (Probiotic and Prebiotic Foods):  দই, কিমচি, সওয়ারক্রাউট (প্রোবায়োটিক); রসুন, পেঁয়াজ, কলা (প্রিবায়োটিক)।

কেন উপকারী: প্রোবায়োটিক খাবার অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং হজমকে সহায়তা করে। এর ফলে প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করতে পারে।

কিভাবে সহায়ক: হজমতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতা এবং অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের মাধ্যমে শরীরকে শিথিল রাখতে সহায়ক হয়।

৪. শাক-সবজি ও ফলমূল: পালং শাক, ব্রোকোলি, গাজর, আপেল, বেরিজ, সাইট্রাস ফল।

কেন উপকারী: শাক-সবজি ও ফলমূলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন রয়েছে, যা মানসিক চাপ কমায় এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে।

কিভাবে সহায়ক: এই খাবারগুলো সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত সক্রিয়তা কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরকে শিথিল রাখে, ফলে প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম সক্রিয় হয়।

৫. কম ক্যাফেইনযুক্ত ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পানীয়: গ্রিন টি, হারবাল টি (চামোমাইল, পেপারমিন্ট), লেবু পানি।

কেন উপকারী: গ্রিন টিতে কম পরিমাণ ক্যাফেইন থাকে এবং এতে থিওনাইন নামে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করতে সহায়ক। হারবাল টি মানসিক চাপ কমায় এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করে।

কিভাবে সহায়ক: এসব পানীয় স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে, যা অনিদ্রা, স্ট্রেস, এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।

৬. ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: বাদাম, কুমড়ার বীজ, পালং শাক, অ্যাভোকাডো।

কেন উপকারী: ম্যাগনেসিয়াম এমন একটি খনিজ, যা স্নায়ু এবং পেশীর শিথিলতায় সহায়ক। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত সক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

কিভাবে সহায়ক: ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপকে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সঠিকভাবে কার্যকর করে।

৭. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: মাছ, ডাল, ডিম, চর্বিহীন মাংস।

 কেন উপকারী: প্রোটিন শরীরের সার্বিক বিকাশ এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় ভূমিকা রাখে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক, যা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

কিভাবে সহায়ক: প্রোটিন সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের উত্তেজনা কমিয়ে প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করতে সহায়ক।

৮. কম শর্করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়ানো: চিনি, সোডা, ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাকস।

কেন ক্ষতিকর: এসব খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায় এবং দ্রুত নামিয়ে আনে, যা সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে অতিরিক্ত সক্রিয় করে তোলে এবং স্ট্রেস বাড়ায়।

কিভাবে সহায়ক: প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে রক্তের শর্করার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা গেলে, সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম কম সক্রিয় হয় এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করে।

সারসংক্ষেপে, সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের ভারসাম্য বজায় রাখতে যেসব খাবার সহায়ক:

    হোল গ্রেইন (ব্রাউন রাইস, ওটস) এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার।

    ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (মাছ, চিয়া সিড)।

    প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক খাবার (দই, রসুন)।

    শাক-সবজি ও ফলমূল (পালং শাক, ব্রোকোলি, আপেল)।

    ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (বাদাম, কুমড়ার বীজ)।

    গ্রিন টি ও হারবাল টি।

    প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত শর্করা এড়ানো।

সুস্থ এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা গেলে সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের অতিরিক্ত সক্রিয়তা কমানো এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব।

Related Posts

সর্বশেষ পোস্ট

সর্বাধিক পঠিত পোস্ট

Scroll to Top