হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কখন যেতে হয়?

জরুরি বিভাগ (Emergency Department) হলো একটি হাসপাতালের এমন বিভাগ, যেখানে রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেকোনো গুরুতর এবং জীবন-মৃত্যুর সংকটময় অবস্থায় রোগীকে দ্রুত জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে হয়। জরুরি বিভাগের মূল কাজ হলো রোগীর অবস্থা অনুযায়ী তাকে দ্রুত সেবা প্রদান করা, যাতে জীবন বাঁচানো যায় বা গুরুতর অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটে।

জরুরি বিভাগে সাধারণত রোগীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদান করা হয় এবং এখানে চিকিৎসক, নার্স, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসা দেন।

কখন জরুরি বিভাগে যেতে হয়?

জরুরি বিভাগে যেতে হয় এমন কয়েকটি সাধারণ পরিস্থিতি নিচে উল্লেখ করা হলো:

  1. হৃদরোগ বা বুকে প্রচণ্ড ব্যথা:
    • যদি রোগী বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে, তাহলে জরুরি বিভাগে দ্রুত যেতে হবে।
    • হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো হতে পারে— বুকে চাপ লাগা, বাম হাত বা কাঁধে ব্যথা, ঘাম হওয়া ইত্যাদি।
  2. স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ:
    • যদি রোগীর হঠাৎ করে শরীরের কোনো অংশ অসাড় হয়ে যায়, কথা বলার সমস্যা হয়, বা মুখের একপাশ ঝুলে পড়ে, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এটি স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে।
  3. গুরুতর আঘাত বা দুর্ঘটনা:
    • কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা, যেমন— সড়ক দুর্ঘটনা, উচ্চতা থেকে পড়ে যাওয়া বা মাথায় আঘাত পাওয়া হলে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
    • এতে শরীরের হাড় ভেঙে যাওয়া, মাথায় আঘাত, অথবা অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হতে পারে, যা জীবনঘাতী হতে পারে।
  4. শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে অসুবিধা:
    • যদি রোগী শ্বাস নিতে কষ্ট করে, শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত বা ধীর হয়ে যায়, তাহলে তাকে জরুরি বিভাগে নিতে হবে।
    • অ্যাজমা বা গুরুতর অ্যালার্জির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  5. অবচেতন অবস্থা বা জ্ঞান হারানো:
    • যদি রোগী হঠাৎ করে জ্ঞান হারায় বা অবচেতন অবস্থায় থাকে, তবে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিতে হবে।
    • এর পেছনে কারণ হতে পারে— স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, বা মস্তিষ্কে আঘাত।
  6. রক্তপাত:
    • শরীরের যেকোনো স্থানে বড় ধরনের আঘাতের ফলে রক্তপাত হলে এবং তা বন্ধ না হলে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
    • অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ক্ষেত্রে লক্ষণ হতে পারে— পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথা ঘোরা, এবং রক্ত বমি হওয়া।
  7. বার্ন বা পোড়া:
    • যদি কেউ আগুন, রাসায়নিক বা বিদ্যুৎপৃষ্টে পুড়ে যায় এবং শরীরের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
  8. গর্ভাবস্থার জটিলতা:
    • গর্ভাবস্থায় গুরুতর রক্তপাত, হঠাৎ তীব্র ব্যথা বা প্রসব বেদনার সময় আগেই পানি ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি জটিলতায় জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।
  9. বিষক্রিয়া বা ওষুধের অতিরিক্ত মাত্রা:
    • যদি কেউ ভুলক্রমে বিষাক্ত পদার্থ সেবন করে, কীটনাশক খেয়ে ফেলে, অথবা কোনো ওষুধের অতিরিক্ত মাত্রা নিয়ে থাকে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
  10. গুরুতর অ্যালার্জি:
    • যদি কোনো খাবার, ওষুধ বা অন্য কোনো উপাদানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্বাসকষ্ট, শরীর ফুলে যাওয়া বা ত্বকে চুলকানি হয়, তবে এটি গুরুতর অ্যালার্জির লক্ষণ হতে পারে।

জরুরি বিভাগে যেতে হলে কি কি প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়?

জরুরি অবস্থায় সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিলে রোগীকে দ্রুত সেবা প্রদান করা যায় এবং তার জীবন বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। নিচে জরুরি বিভাগের প্রস্তুতির কিছু প্রধান বিষয় আলোচনা করা হলো:

  1. জরুরি কাগজপত্র ও পরিচয়পত্র:
    • রোগীর পরিচয়পত্র এবং পূর্বের চিকিৎসার সমস্ত কাগজপত্র সাথে রাখা উচিত। এর মধ্যে রোগীর প্রেসক্রিপশন, মেডিক্যাল রিপোর্ট, ওষুধের তালিকা ইত্যাদি থাকতে পারে।
    • রোগীর কোন ওষুধে এলার্জি আছে তা জানা থাকলে সেটি উল্লেখ করা উচিত।
  2. সঙ্গে একজন সহকারী রাখা:
    • জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীর সাথে একজন সহকারী থাকা উচিত, যিনি দ্রুত সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে পারবেন।
    • সহকারী ব্যক্তিকে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত থাকতে হবে এবং হাসপাতালে তথ্য প্রদানে সহায়তা করতে হবে।
  3. জরুরি নম্বর এবং যোগাযোগ:
    • জরুরি চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালগুলোর ফোন নম্বর সাথে রাখা উচিত।
    • চিকিৎসক বা হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সেবা তাড়াতাড়ি পেতে স্থানীয় জরুরি যোগাযোগের নম্বরও জানা থাকতে হবে।
  4. ওষুধ ও চিকিৎসার তথ্য:
    • রোগী যদি আগে থেকে কোনো ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন, তবে সেই ওষুধের নাম এবং ডোজ সম্পর্কে তথ্য সাথে রাখতে হবে। এতে জরুরি চিকিৎসক সঠিক চিকিৎসা প্রদান করতে পারবেন।
  5. মানসিক প্রস্তুতি:
    • জরুরি পরিস্থিতিতে মনোবল ধরে রাখা জরুরি। সাধারণত জরুরি বিভাগে তাড়াহুড়ো হয়, তাই শান্ত থাকা এবং চিকিৎসকদের নির্দেশনা মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  6. অ্যাম্বুলেন্স সেবা:
    • জরুরি অবস্থায় যদি রোগীকে একা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হয়, তবে হাসপাতালে পৌঁছাতে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স সেবার প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্স সেবা এবং তার ফোন নম্বর জানা রাখা জরুরি।
  7. রোগীর ইতিহাস এবং পূর্ববর্তী সমস্যার জ্ঞান:
    • রোগীর পূর্বের যে কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন— ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, এলার্জি ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সঙ্গে রাখা এবং জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের জানানো গুরুত্বপূর্ণ। এটি রোগীর চিকিৎসার সময় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
  8. ক্যাশ বা ইন্স্যুরেন্স কার্ড:
    • অনেক হাসপাতালেই জরুরি চিকিৎসার সময় তাৎক্ষণিক ফি প্রদান করতে হয়। এজন্য কিছু নগদ টাকা সাথে রাখা উচিত।
    • যদি রোগীর স্বাস্থ্যবীমা (ইন্স্যুরেন্স) থাকে, তবে সেই কার্ড সাথে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

জরুরি বিভাগে কখন যেতে হবে তা বুঝতে পারা এবং সঠিক প্রস্তুতি নেওয়া রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, দুর্ঘটনা, রক্তপাত, এবং বিষক্রিয়া মতো গুরুতর সমস্যায় দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়। এই সময় সঠিক কাগজপত্র, যোগাযোগের নম্বর, ওষুধের তথ্য এবং মনোবল ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি।

Related Posts

সর্বশেষ পোস্ট

সর্বাধিক পঠিত পোস্ট

Scroll to Top