বন্যায় কেউ ডুবে গেলে তাৎক্ষণিক কি করবেন?

ডুবে যাওয়া একজন ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ রয়েছে, যা সঠিকভাবে পালন করলে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। এখানে অবশ্য করণীয় এবং যে কাজগুলো কখনোই করা যাবে না বিষয়গুলো আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

করণীয় পদক্ষেপ:

নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা:

  • সর্বপ্রথম আপনার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে ভেবে নিন যে আপনি নিরাপদে থাকবেন কিনা। পানির গভীরতা, স্রোত, এবং অন্যান্য ঝুঁকির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিন।

ব্যক্তিকে পানির বাইরে নিয়ে আসা:

  • ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে দ্রুত কিন্তু সাবধানতার সাথে পানির বাইরে নিয়ে আসুন। তাদের মাথা এবং ঘাড়ের অংশকে সাপোর্ট দিয়ে পানি থেকে তোলার চেষ্টা করুন যাতে তাদের শ্বাসনালীতে আর পানি না যায়।
  • মাথা এবং ঘাড়কে সামনের দিকে না ঝুঁকিয়ে সোজা রাখুন।

শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া পরীক্ষা করা:

  • ব্যক্তি সাড়া দিচ্ছেন কিনা তা পরীক্ষা করুন। যদি তারা সাড়া না দেয় তবে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া পরীক্ষা করুন।
  • শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকলে বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ থাকলে দ্রুত সিপিআর (CPR) শুরু করতে হবে।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা:

  • ব্যক্তি যদি ঠান্ডা পানিতে ডুবে থাকে, তবে তার শরীর উষ্ণ রাখার চেষ্টা করুন। ভেজা কাপড় খুলে শুকনো কাপড় বা কম্বল দিয়ে মোড়ান।
  • শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলে হাইপোথারমিয়া (Hypothermia) হতে পারে, যা আরও মারাত্মক হতে পারে, তাই উষ্ণ রাখার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সিপিআর (CPR) প্রদান করা:

  • প্রথমে ৫টি মুখে-মুখে শ্বাস দিন। প্রতিটি শ্বাস ১ সেকেন্ডের জন্য দিন এবং লক্ষ করুন যে বুক উঁচু হচ্ছে কিনা।
  • এরপর বুক চাপা (চেস্ট কমপ্রেশন) শুরু করুন।
    • শিশু ও কিশোরদের জন্য: বুকের মাঝখানে (স্টার্নাম) এক হাত বা দুই হাত ব্যবহার করে ৩০টি কমপ্রেশন দিন। প্রতি ৩০টি চাপের পর ২টি শ্বাস দিন।
    • বাচ্চাদের জন্য: দুই আঙুল ব্যবহার করে বুকের মাঝখানে চাপ দিন।
  • CPR চালিয়ে যান যতক্ষণ না ব্যক্তি শ্বাস নিতে শুরু করেন বা চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে।

৫. জরুরি চিকিৎসা সহায়তা ডেকে আনা:

  • একই সাথে সাহায্যের জন্য চিৎকার করুন। যাতে অন্য কেউ এই পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার সুযোগ পায়।
  • CPR চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব জরুরি চিকিৎসা সহায়তা কল করুন (৯৯৯) বা অন্য কোন ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করুন। যদি সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত থাকে, তাকে কল করতে বলুন যাতে আপনি CPR চালিয়ে যেতে পারেন।
  • দ্রুত তাকে হাসপালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।

৬. অক্সিজেন সরবরাহ করা:

  • যদি অক্সিজেন সরবরাহের উপকরণ (অক্সিজেন মাস্ক বা ব্যাগ-ভ্যালভ মাস্ক) উপস্থিত থাকে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ১০০% অক্সিজেন সরবরাহ শুরু করুন।

যে কাজগুলো করা যাবে না

১. বেশি সময় নষ্ট করা:  ব্যক্তি শ্বাস নিচ্ছে কিনা তা চেক করতে বেশি সময় নষ্ট করবেন না। দ্রুত CPR শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।

২. ব্যক্তিকে ঝাঁকানো বা উল্টে দেয়া: পানি ফুসফুস থেকে বের করার জন্য ব্যক্তিকে উল্টানো বা ঝাঁকানো উচিৎ নয়। এটি শ্বাসনালিতে আরও সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিলম্ব করতে পারে।

৩. মুখে-মুখে শ্বাস দিতে বিলম্ব করা: ব্যক্তি যদি শ্বাস না নেয়, তবে দ্রুত মুখে-মুখে শ্বাস দিন। বিলম্ব করলে অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কে ক্ষতি হতে পারে।

৪. সিপিআর-এর সময় খুব হালকা চাপ দেয়া: বুক চাপা দেওয়ার সময় যথেষ্ট জোরে চাপ দিতে হবে যাতে রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন সিপি আর দিনে যাতে বুকের অন্তত এক তৃতীয়াংশ দেবে যায়। শিশুর ক্ষেত্রে বুক চাপার গভীরতা অবশ্যই বয়স এবং শারীরিক গঠন অনুযায়ী হওয়া উচিৎ।

৫. মুখে-মুখে শ্বাসের সময় পানি বের করার চেষ্টা:  মুখে-মুখে শ্বাস দেওয়ার সময় বমি বা পানি বের হতে পারে। তখন তাকে কাত করে দিন। তবে এর জন্য ব্যক্তির মাথা উল্টানো বা বেশি ঝাঁকানো উচিৎ নয়। এটি উলটো শ্বাসনালীতে গিয়ে এস্পিরেশন ঘটাতে পারে যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে।

৬. হাসপাতালে নিতে দেরী করাঃ ডুবে যাওয়ার পর যদি ব্যক্তি অজ্ঞান থাকে বা CPR-এর পরেও সাড়া না দেয়, তবে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। ডাক্তারি চিকিৎসা পেতে দেরি করা বিপদজনক হতে পারে।

সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে ডুবে যাওয়া ব্যক্তির জীবন রক্ষা করা সম্ভব। CPR প্রদান এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া, রোগীকে উষ্ণ রাখা, অক্সিজেন সরবরাহ করা, এবং দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা ডেকে আনা উচিত।

পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কী কী করবেন?

পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হয় যা ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব। নিচে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধের জন্য কিছু কার্যকরী পরামর্শ দেওয়া হলো:

  • শিশুদের প্রতি নজর রাখা: শিশুদের পানির কাছাকাছি কোনো অবস্থায় একা থাকতে দেবেন না। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের পানির কাছাকাছি খেলতে দিলে একজন প্রাপ্তবয়স্কের সর্বদা উপস্থিত থাকা উচিত।
  • সাঁতার শেখানো: শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সাঁতার শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাঁতার জানা থাকলে পানিতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
  • লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার: যারা সাঁতার জানেন না তাদের জন্য লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক করা উচিত। এমনকি যারা সাঁতার জানেন তাদেরও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় লাইফ জ্যাকেট পরা উচিত।
  • পানির চারপাশে বেড়া দেওয়া: বাড়ির আশেপাশে কোন পুকুর বা জলাশয় থাকলে তা ঘিরে রাখা এবং গেটের লক ঠিকমতো করা উচিত, যেন শিশু বা অন্য কেউ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সেখানে ঢুকতে না পারে।
  • পানিতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে শিক্ষা: শিশু এবং বড়দের পানিতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি এবং এর প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। স্কুল এবং কমিউনিটিতে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
  • প্রবাহিত জলাশয় এড়িয়ে চলা: বন্যার সময় বা প্রবল স্রোতের সময় ঝুঁকিপূর্ণ জলাশয় বা নদীর কাছে না যাওয়াই ভালো।
  • প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা: বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকা উচিত যারা দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারে।
  • CPR শেখা: প্রাপ্তবয়স্কদের CPR (Cardiopulmonary Resuscitation) শেখানো উচিত যাতে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে তারা তাৎক্ষণিক সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারে।

Related Posts

সর্বশেষ পোস্ট

সর্বাধিক পঠিত পোস্ট

Scroll to Top