অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) এর বিভিন্নতা (Variability in Autism Spectrum Disorder – ASD)
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) একটি জটিল এবং বৈচিত্র্যময় বিকাশগত ব্যাধি, যা বিভিন্ন উপায়ে এবং বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পায়। ASD এর এই বৈচিত্র্যতার কারণে একে “স্পেকট্রাম” বলা হয়। প্রতিটি ব্যক্তির অটিজমের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে, এবং তাদের চাহিদা ও সমর্থনের প্রয়োজনও আলাদা হতে পারে।
ASD এর বিভিন্ন রূপ (Different Forms of ASD)
- ক্লাসিকাল অটিজম (Classic Autism):
- এটি ASD এর সবচেয়ে পরিচিত রূপ। সামাজিক যোগাযোগ, ভাষা বিকাশ, এবং আচরণগত পুনরাবৃত্তিমূলকতা এতে প্রবলভাবে দেখা যায়।
- এই রূপে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং নির্দিষ্ট আচরণ ও রুটিনে অটুট থাকে।
- এস্পারগার সিন্ড্রোম (Asperger’s Syndrome):
- সামাজিক যোগাযোগ এবং আচরণগত সমস্যার উপস্থিতি থাকলেও ভাষা বিকাশ সাধারণত স্বাভাবিক থাকে।
- সাধারণত উচ্চতর বুদ্ধিমত্তা এবং নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর আগ্রহ দেখা যায়।
- সামাজিক সংকেত বুঝতে সমস্যা হলেও মৌখিক যোগাযোগ দক্ষতা ভালো হতে পারে।
- পেরভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার-নট আদারওয়াইজ স্পেসিফাইড (PDD-NOS):
- অন্যান্য নির্দিষ্ট রূপের সাথে মিল নেই এমন শিশুদের এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
- এদের আচরণে কিছু কিছু অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ক্লাসিকাল অটিজম বা এস্পারগার সিন্ড্রোমের মতো নয়।
- রেট সিন্ড্রোম (Rett Syndrome):
- এই রূপটি সাধারণত মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় এবং জন্মের পর প্রথম ১৮ মাস পর্যন্ত স্বাভাবিক বিকাশের পর হঠাৎ করে দক্ষতা হারিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করা যায়।
- হাতে পুনরাবৃত্তিমূলক গতি (যেমন হাত ধরা বা মুঠো করা) এবং মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা পড়ে।
ASD এর বিভিন্ন মাত্রা (Different Levels of ASD Severity)
ASD এর তীব্রতার মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে, যা সাধারণত নিম্নোক্ত স্তরগুলির মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়:
- লেভেল ১: কিছু সহায়তার প্রয়োজন (Level 1: Requiring Support):
- সামাজিক যোগাযোগে কিছু সমস্যা থাকে, কিন্তু ব্যক্তিগত সহায়তা ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকতে পারে।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ কম এবং রুটিন পরিবর্তন সহ্য করতে সক্ষম।
- লেভেল ২: উল্লেখযোগ্য সহায়তার প্রয়োজন (Level 2: Requiring Substantial Support):
- সামাজিক যোগাযোগে উল্লেখযোগ্য সমস্যা থাকে এবং দৈনন্দিন কার্যকলাপে বিশেষ সহায়তার প্রয়োজন হয়।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ ও রুটিনের প্রতি বেশি নির্ভরতা দেখা যায়।
- লেভেল ৩: অত্যন্ত সহায়তার প্রয়োজন (Level 3: Requiring Very Substantial Support):
- সামাজিক যোগাযোগে প্রচুর সমস্যা থাকে এবং স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে অক্ষম।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ প্রবল এবং রুটিনে সামান্য পরিবর্তনেও অস্থির হয়ে ওঠে।
ASD এর বিভিন্ন লক্ষণ এবং তাদের বহিঃপ্রকাশ (Manifestation of Different ASD Symptoms)
ASD এর লক্ষণগুলি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে, যেমন:
- ভাষা বিকাশে বিলম্ব: কিছু শিশু কথা বলায় দেরি করে বা মোটেই কথা বলে না।
- সামাজিক সংকেত বোঝার সমস্যা: শিশুদের মধ্যে চোখের সংস্পর্শে অসুবিধা এবং সামাজিক সম্পর্ক গঠনে কষ্ট হয়।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ: নির্দিষ্ট গতি বা কার্যকলাপ বারবার করা।
- সংবেদনশীলতা: আলো, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ বা স্পর্শের প্রতি অতিসংবেদনশীল হওয়া।
ASD এর এই বৈচিত্র্যময় প্রভাবের কারণে প্রতিটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা এবং তাদের সমর্থনের প্রয়োজন ভিন্ন হতে পারে। উপযুক্ত থেরাপি এবং সহায়তার মাধ্যমে তাদের জীবনের গুণগত মান উন্নত করা সম্ভব।
অটিজমের কারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) একটি জটিল স্নায়বিক বিকাশগত ব্যাধি, যার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি। তবে, গবেষণা বিভিন্ন জেনেটিক এবং পরিবেশগত ফ্যাক্টরকে অটিজমের সাথে সম্পর্কিত বলে চিহ্নিত করেছে। এই অধ্যায়ে আমরা অটিজমের সম্ভাব্য কারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর নিয়ে আলোচনা করব।
অটিজমের কারণ (Causes of Autism)
১. জেনেটিক কারণ (Genetic Factors):
- জেনেটিক মিউটেশন: বিভিন্ন গবেষণা অটিজমের সাথে বিভিন্ন জেনেটিক মিউটেশন এবং অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করেছে। যেমন, CHD8, SHANK3, এবং SCN2A জিনগুলির মিউটেশন অটিজমের সাথে সম্পর্কিত।
- পারিবারিক ইতিহাস: অটিজমের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, শিশুর অটিজম হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যমজ শিশুদের মধ্যে একজন যদি অটিজমে আক্রান্ত হয়, তাহলে অন্যজনের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
২. স্নায়ুবিজ্ঞানীয় কারণ (Neurobiological Factors):
- মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতা: অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতায় বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেছে। যেমন, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সংযোগের অস্বাভাবিকতা এবং নিউরনগুলির মধ্যে সিগন্যাল ট্রান্সমিশনের সমস্য।
- স্নায়ুবিক রাসায়নিক পদার্থ: মস্তিষ্কে সেরোটোনিন এবং অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারদের অস্বাভাবিকতা অটিজমের সঙ্গে সম্পর্কিত।
৩. পরিবেশগত কারণ (Environmental Factors):
- গর্ভকালীন সংক্রমণ: গর্ভাবস্থায় ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যেমন রুবেলা বা সাইটোমেগালোভাইরাস (CMV) এর সংক্রমণ, অটিজমের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।
- পরিবেশগত দূষণ: বায়ু দূষণ, কীটনাশক, এবং ভারী ধাতু (যেমন পারদ) সহ বিভিন্ন পরিবেশগত দূষণ অটিজমের ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় ওষুধের ব্যবহার: গর্ভাবস্থায় কিছু ওষুধের ব্যবহার, যেমন থ্যালিডোমাইড এবং ভ্যালপ্রোট, অটিজমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৪. গর্ভকালীন সমস্যা (Prenatal Factors):
- মাতৃত্বকালীন সমস্যা: গর্ভাবস্থায় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, এবং গর্ভাবস্থার সময় রক্তচাপ বৃদ্ধি অটিজমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- জন্মকালীন সমস্যা: জন্মের সময় অক্সিজেনের অভাব বা প্রি-টার্ম ডেলিভারি অটিজমের ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর (Risk Factors)
১. লিঙ্গ:
- অটিজমের ঝুঁকি পুরুষ শিশুদের মধ্যে নারীদের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি।
২. পরিবারে অটিজমের উপস্থিতি:
- পরিবারের মধ্যে একাধিক সদস্য অটিজমে আক্রান্ত হলে, অন্যান্য সদস্যদের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
৩. পিতা-মাতার বয়স:
- বয়স্ক পিতা-মাতার (বিশেষত ৪০ বছরের উপরে) সন্তানদের অটিজমের ঝুঁকি বেশি।
৪. অন্যান্য রোগ এবং ব্যাধি:
- কিছু জেনেটিক ব্যাধি, যেমন ফ্রাজাইল এক্স সিন্ড্রোম, টুবেরাস স্ক্লেরোসিস, এবং ডাউন সিন্ড্রোম, অটিজমের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
উপসংহার (Conclusion)
অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি, তবে বিভিন্ন জেনেটিক এবং পরিবেশগত ফ্যাক্টর এটির ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গর্ভকালীন এবং জন্মকালীন সমস্যাগুলি অটিজমের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। আধুনিক গবেষণা এই ফ্যাক্টরগুলি আরও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে, যা অটিজমের প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অটিজম সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া বৃদ্ধি করার মাধ্যমে, আমরা অটিজম শিশুদের সমর্থন এবং সহায়তায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।